Posts Tagged ‘সার্জেন্ট জহুরুল হক’

সার্জেন্ট জহুরুল হক (জন্মঃ ৯ ফেব্রুয়ারি , ১৯৩৫ – মৃত্যুঃ
১৫ ফেব্রুয়ারি , ১৯৬৯) আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম
আসামী ও শহীদ ব্যক্তিত্ব।
image

জহুরুল হক ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৫ সালে নোয়াখালী জেলার
সোনাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩
সালে নোয়াখালী জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন।
এবং ঐ বছরই পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদান
করেন। কালক্রমে তিনি ‘সার্জেন্ট’ পদে উন্নীত হন। ১৯৬৭
সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান
সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় গ্রেফতার হন সার্জেন্ট
জহুরুল হক। পরবর্তীতে সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা কেন্দ্রীয়
কারাগারে আটকে রাখা হয়। ৬ জানুয়ারি, ১৯৬৮ সালে ২
জন সি. এস. পি অফিসারসহ ২৮জনকে গ্রেফতার করা হয়।
তাঁদের গ্রেফতার সম্পর্কে সরকারী প্রেসনোটে উল্লেখ
করা হয় যে,

“গত মাসে (অর্থাৎ ডিসেম্বর, ১৯৬৭)
পূর্ব-পাকিস্তানে উদ্ঘাটিত জাতীয়
স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত
থাকার অভিযোগে এঁদের গ্রেফতার
করা হয়েছে।”

তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই
ষড়যন্ত্রকে “আগরতলা ষড়যন্ত্র” নামে অভিহিত করে। এই
একই অভিযোগে ১৭ জানুয়ারি, ১৯৬৮ সালে বিশিষ্ট
রাজনীতিবিদ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ
মুজিবুর রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়।
৩৫জনকে আসামী করে সরকার পক্ষ মামলা দায়ের করে।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র
মামলাটির সরকারী নাম রেখেছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ
মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার’। এই মামলায়
৩৫জনকে আসামী করা হয়। তন্মধ্যে –
১নং আসামী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাখা হয়।
সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৭নং আসামী হিসেবে উল্লেখ
করা হয়। প্রথমে আসামীদেরকে ‘দেশরক্ষা আইন’
থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তীতে ‘আর্মি, নেভি অ্যান্ড
এয়ারফোর্স অ্যাক্টে’ সার্জেন্ট জহুরুল হক-সহ অন্যান্য
আসামীকে পুণরায় গ্রেফতার করে সেন্ট্রাল জেল
থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। ১৯
জুন, ১৯৬৮ সালে মামলাটির শুনানি কার্যক্রম শুরু হয়।
রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার
শিরোনামের মামলার অভিযোগনামায় উল্লেখ
করা হয়েছিল যে,

“অভিযুক্তরা ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের
সাহায্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ
ঘটিয়ে কেন্দ্র থেকে পূর্ব
পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন
করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন
করতে চেয়েছিল।”

মামলার স্থান হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের
অভ্যন্তরে অবস্থিত ‘সিগন্যাল অফিসার মেসে’ নির্ধারণ
করা হয়। মামলার শেষ তারিখ ছিল ৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯
সালে। প্রবল গণ-আন্দোলন তথা উত্তাল ঊনসত্তরের গণ-
অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র
মামলা প্রত্যাহার করতে একান্ত বাধ্য হয়। ঊনসত্তরের
গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের মানুষ
স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র
মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমান-সহ
অন্যান্যদের মুক্তির দাবী করেছিল। সরকার প্রধান
হিসেবে আইয়ুব খান সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক
দলগুলোকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করতে বাধ্য
হয়েছিলেন। ঠিক এ সময়টিতেই সার্জেন্ট জহুরুল হকের
জীবনে মর্মান্তিক
ঘটনা ঘটে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে।
সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দীনিবাসে থাকাকালীন
সময়ে তাঁকে প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত
পাকিস্তানী সৈনিকের হাতে থাকা রাইফেলের
গুলিতে বিদ্ধ হন। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ তারিখের
সন্ধ্যায় ক্যান্টমেন্টে সৈনিকদের খাবারের উচ্ছিষ্ট
সংগ্রহের জন্য বাঙালি শিশুরা ভিড় করে।
এতে অবাঙালি সৈনিকেরা কয়েকজন অভুক্ত
শিশুকে ধরে এনে বন্দী শিবিরের
সামনে অমানবিকভাবে প্রহার শুরু করে।
কয়েকজন বন্দী এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানালে হাবিলদার
‘মনজুর শাহ’ বন্দীদের নিজ নিজ কামরায়
ফিরে যেতে আদেশ করেন। জহুরুল হক সে আদেশ
উপেক্ষা করে মনজুর শাহের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত
হয়ে পড়েন। এতে মনজুর শাহ প্রচণ্ডভাবে রাগান্বিত
হয়ে রাইফেলের বেয়োনেট লাগিয়ে তাঁর
দিকে ধেয়ে আসেন। কিন্তু সার্জেন্ট জহুরুল হক পাশ
কাটিয়ে আক্রমণকারীর হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেন
এবং বিজয়ী বীরের মতো কামরার দরজায়
গিয়ে তাকে রাইফেল ফেরত দেন।’
পরদিন অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ তারিখ
ভোরবেলা জহুরুল হক ঘর থেকে বের হলে মনজুর শাহ
তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। ঐ গুলিটি তাঁর পেটে বিদ্ধ
হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে কম্বাইন্ড মিলিটারী হাসপাতাল
বা সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঐদিন রাত
৯টা ৫৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
ছাত্রদের আবাসিক হলরূপে ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন
করে। দেশের মুক্তির লক্ষ্যে তাঁর অসামান্য অবদানের
কথা বিবেচনায় এনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলটির
নূতন নামকরণ করেন ‘সার্জেন্ট জহুরুল হক হল’।
এ ছাড়াও তার নামে বিমান বাহিনীর একটি ঘাটি ও আছে
যা “জহুর ঘাটি” নামে পরিচিত।
সার্জেন্ট জহুরুল হক স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক সৈনিক
ছিলেন। তাঁর সহকর্মীদের ভাষায় –

“তাঁকে কখনো কাঁদতে দেখা যায়নি।
কোনো কারণে কারো কাছে মাথা নত
করেননি।”

এজন্যে সহকর্মী বন্ধুরা তাঁকে ‘মার্শাল’ বলে ডাকতেন।
তাঁর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আইয়ুব বিরোধী গণ-
আন্দোলন আরো গতি লাভ করে। ব্যাপক গণ-বিক্ষোভের
মুখে ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ তারিখে আইয়ুব খান সরকারের পতন
ঘটে। তাঁর শহীদ স্মৃতি পূর্ব বাংলায়
বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শাণিত করে তোলার
ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ গণ-
আন্দোলনের পথ ধরেই পরবর্তীতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের
মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ
প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে। জহুরুল হক
‘বাঙালি জাতির সূর্য সন্তান’ হিসেবে আখ্যায়িত
হয়ে থাকবেন চিরকাল।
সাঁতার কাটা, খেলাধূলা, ছবি তোলা, ছবি আঁকা, কাঠের
কাজ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে দক্ষতা ছিল তাঁর। সার্জেন্ট
জহুরুল হকের অঙ্কিত চিত্রকর্ম ঢাকা জাদুঘরে
সযত্নে সংরক্ষিত আছে।

সুত্রঃ উইকিপিডিয়া
ছবিঃ বা বি বা মিউজিয়াম